রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী : কঠিন কথা লিখেন যিনি সহজে

রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী : কঠিন কথা লিখেন যিনি সহজে সাত-আট বছর আগের কথা। তখন আমি কক্সবাজারের পোকখালী মাদরাসায় লেখাপড়া করি। পোকখালী মাদরাসা যেহেতু ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের অধীনে ছিলো, তাই সঙ্গত কারণেই জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাথে আমাদের একটা আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তখনও বুঝতাম না কিছুÑ কিন্তু এতটুকু অবশ্যই বুঝতাম যে, পটিয়া মাদরাসা আমাদের চেতনার আকর এবং বাতিঘর। আবার পটিয়া মাদরাসার শিক্ষকরা ছিলেন আমাদের কাছে দূর আকাশের নক্ষত্রের মতো। যাঁদের কল্পনা করা যায়, কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। কারণ আমাদের পাঠ্যবইয়ের অধিকাংশ ব্যাখ্যাগ্রন্থই ছিলো তাঁদের রচিত। তন্মধ্যে কুতবে আলম মুফতী আযীযুল হক রহ., মুফতী ইবরাহীম রহ., মাওলানা রফিক আহমদ, মাওলানা রহমতুল্লাহ কাউসার নেজামী প্রমুখ অন্যতম। এদিকে আমরা নতুন কিতাবের কালেভদ্রেই দেখা পেতাম। তাই কেউ চট্টগ্রাম বা পটিয়া থেকে নতুন কিতাব নিয়ে এলে তার পাশে ছাত্রদের একটা জটলা হয়ে যেত। কোনো নতুন কিতাব দেখামাত্র ওই কিতাবটি নাড়াচাড়া করা, পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখা, ভূমিকা কার লেখা, এসব দেখার একটা ‘বদঅভ্যাস’ ছিলো সেই বাল্যকাল থেকেই। (আলহামদুলিল্লাহ এখনও সযতেœ লালন করি সেই 'বদঅভ্যাস'। পরে অবশ্যই জানলাম, আমাদের পূর্ববর্তী বুজুর্গদের অনেকের নাকি সেই 'রোগটি' ছিলো। আমাদের সমকালের ইসলামী সাহিত্যের দিকপাল মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবও নাকি সেই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ছিলেন।)
একদিন এক অভূতপূর্ব সংবাদ শুনলাম। বাংলাদেশী আবার পটিয়ার এক আলেমের বই প্রকাশিত হয়েছে ভারতের এক সম্ভ্রান্ত লাইব্রেরী থেকে। আমাদের এক ছাত্র ভাই ওই কিতাবটি নিয়ে এসেছেন। সংবাদটি শোনামাত্র আমরা তার কাছে হুড়মুড় করে গেলাম। যাওয়ার পর দেখি পটিয়া মাদরাসার মাওলানা রফিক আহমদ সাহেবের রচিত ঈযাহুল মিশকাত। কিতাবটি পূর্বে বহুবার দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো, কিন্তু বিদেশে মুদ্রিত কিতাবের মান যে এত উন্নতমানের হয়, তা আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না। সেই কিতাব খুলে দেখি, ভূমিকায় গ্রন্থকারের জীবনী। জীবনী লেখকের নাম দেখে আমি আরো অবাক, রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী, একেবারে আমার নামে নাম! সেদিনই তাঁর নামের সাথে আমার পরিচয়। এরপর আমি পটিয়া মাদরাসায় চলে আসি। তারপর সামনাসামনি সাক্ষাৎ, তার কাছ থেকে উপকৃত হওয়া, আরো কত কি?
এতক্ষণ বলছিলাম নীরব সাধক মাওলানা রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদীর কথা। পারিবারিক সূত্রে তিনি যেমন পেয়েছিলেন তাকওয়ার স্বর্গীয় পরিবেশ, তেমনি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উম্মাহর নাযুকতম মুহূর্তে মসি’র শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে রণাঙ্গণে নামার যথেষ্ট মাল-মশলা। তাঁর পিতামহ মাওলানা ইমাম আহমদ রহ. একদিকে ছিলেন যুগের বিস্ময়, চলন্ত লাইব্রেরীখ্যাত আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর বিশিষ্ট শিষ্য, অপরদিকে তাকওয়া, খোদাভীতির অনন্যাসনে সমাসীন। পটিয়া মাদরাসার কেন্দ্রীয় মসজিদে সুদীর্ঘকাল ইমামতি করার সুবাদে ইমাম সাহেব নামে অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন এ অঞ্চলে। তাঁর সমসাময়িকদের বক্তব্য হচ্ছে, কখনো ছুটতে দেখা যায়নি তাঁর তাকবীরে উলা। আর তাঁর পিতা মাওলানা রফীক আহমদ, ইসলামের প্রায় মৌলিক সব বিষয়ে রয়েছে তাঁর সরব পদচারণা। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে মুসলিম উম্মাহকে পান করাচ্ছেন সঞ্জীবনী সূধা। মিশকাত শরীফের অনবদ্য ও অমর ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'ঈযাহুল মিশকাত' সমাদৃত হয়েছে দেশ-বিদেশের সর্বমহলে। জ্ঞানের মাতৃক্রোড় দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরীর পবিত্র মুখ থেকে এসেছে তাঁর এই অসামান্য কীর্তির ওপর স্তুতি-বন্দনা। মোটকথা, একই যুগের বাসিন্দা হয়েও মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়, তিনি যেন সেই দূর স্বপ্নালোকের বাসিন্দা এবং আকাশের উজ্জ্বল সেতারা। মোটকথা, খোদাভীতি আর লেখনীর উভয় গ্রোতস্বতীতে অবগাহনে সিক্ত হলেন তিনি সেই শৈশবকালে। তাই মানসপটে জ্বলজ্বল করে সর্বদা খোদাভীতি, আর লেখালেখির প্রতি প্রেরণা, অনুরাগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয় সেই কৈশোর থেকে।
জন্ম :
তিনি ১৯৭১ ইং মোতাবেক ১৩৯০ হিজরীতে পটিয়ার এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখাপড়া :
তিনি ছোটবেলায় নুরানী কায়দা ইত্যাদি শেষ করার পর ৭ বছর বয়সে তাঁকে তাঁর সম্মানিত দাদা এবং জামিয়া পটিয়ার তৎকালীন প্রধান পরিচালক হযরত হাজী সাহেব, জামিয়ার তৎকালীন সহকারী পরিচালক ফকীহুল মিল্লাত মুফতী আবদুর রহমানসহ আরো বড় বড় আলেমের উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের সবক দেয়া হয়। তখন থেকে জামিয়া পটিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৮১ সনে চন্দনাইশস্থ বশরতনগর রশীদিয়া মাদরাসায় মিজান জামাআতে ভর্তি হয়ে হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত সেখানে শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৮৫ থেকে পুনরায় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় ভর্তি হয়ে ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। ১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে জামিয়া পটিয়ার বাংলা সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা বিভাগে এক বছর শিক্ষা অর্জন করেন।
এরপর তাঁর পিতার বিভিন্ন প্রকাশনা ও লাইব্রেরী তথা আশরাফিয়া লাইব্রেরীর পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন দীনি খেদমাত আঞ্জাম দেন। ১৯৯৬ সালে নিজেদের প্রকাশনায় সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লায় 'আহমদিয়া কম্পিউটার এণ্ড প্রিন্টার্স' নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করেন।
লেখালেখির হাতেখড়ি :
পিতার কাছে ঘরোয়া পরিবেশেই লেখালেখির হাতেখড়ি। প্রথমে পিতার উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতেন। পরবর্তিতে একটা দায়বদ্ধতা থেকেই লেখালেখিতে ব্যাপৃত হন। যশ-খ্যাতি নয়, তদানীন্তন সময়ে মুসলিম লেখকদের বন্ধ্যাত্য ঘোচাতে ময়দানে অবতরণ করলেও এখন লিখেন হৃদয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে।
গল্প-উপন্যাস, অনুবাদ সাহিত্য, মৌলিক লেখালেখি, রাজনীতি, সমকালীন, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ প্রায় সব বিভাগে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ঈশাণ, দৈনিক কর্ণফুলী, দৈনিক নয়া বাংলাসহ অনেক দৈনিকই গুরুত্বসহকারে ছাপতো তাঁর লেখা। তৎকালীন প্রায় ইসলামী পত্রিকাই সমৃদ্ধি ছিলো তার লেখা দ্বারা। মাসিক মদীনা, মাসিক আত-তাওহীদ, মাসিক পয়গামে হক, মাসিক আর রশীদ, মাসিক দা’ওয়াতুল হক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, মাসিক আল-হাসান, মাসিক পটিয়া, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান ইত্যাদিতে প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলোকে একত্রিত করলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের রূপ পাবে নিঃসন্দেহে।
সর্বপ্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ :
তাঁর সর্বপ্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘সর্বনাশা প্রেম’ পাঠকমহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়। মৌলিক গল্প-উপন্যাসে তার যথেষ্ট পারঙ্গমতা সত্ত্বেও সে পথে তিনি কেন এগোননি, তা আজও এক অনুদ্ঘাটিত রহস্য। সে পথে এগোলে আমাদের গল্প-উপন্যাসের ঝুলি যে আরো সমৃদ্ধ হতো, সে কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। তাঁর আরেকটি কীর্তি হচ্ছে, আল্লামা দামিরীর অমরগ্রন্থ হায়াতুল হায়ওয়ানের বাংলা অনুবাদ। বইটি তখনও পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলে এবং বর্তমানেও এর পাঠকপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। তাঁর সংকলিত ও অনূদিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, যাদুত্তালেবীন, আল ফিকহুল মুয়াসসার, তালীমুল মুতাআল্লিম, ফারসী কী পহেলী কিতাব, আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, খেলাফতে রাশেদা প্রভৃতি। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে 'পবিত্র কুরআন সুন্নাহর আলোক সহীহ শুদ্ধ নামায'। তাঁর জীবনের অন্যতম অমর কীর্তি, তাঁর পিতাজীর অনবদ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'ঈযাহুল মিশকাত' পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডের বাংলা অনুবাদ। মূল ঈযাহুল মিশকাতের মতো অনূদিত ঈযাহুল মিশকাতও পাঠকসমাজে বেশ সমাদৃত হয়েছে। 
দেশের অন্যতম সাময়িকী আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপত্র মাসিক আত তাওহীদের সহসম্পাদকের গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন ২০০৪ ও ২০০৫ সালে। তখন আত তাওহীদে লিখিত ইরাক-আফগানিস্তান বিষয়ে তাঁর লিখিত প্রবন্ধাবলী আমার মতো অনেকের হৃদয়ে মুসলিম উম্মাহর প্রতি দরদ আর ভালবাসা সৃষ্টিতে অত্যন্ত সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ মুরব্বী ফকীহুল মিল্লাহ মুফতি আবদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত মাসিক আল আবরারের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য, যেকোনো কঠিন থেকে কঠিন বিষয়কে তিনি তুলে আনতে পারেন অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায়। একাগ্রধ্যান, অবিচলিত নিষ্ঠা, একান্ত বিশ্বাস এবং লেখালেখির প্রতি অকৃত্রিম টান থেকে এই ময়দানে লড়াকু সৈনিকের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁর স্বপ্ন :
তাঁর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন, তাঁর পিতাজীর গ্রন্থগুলোকে বাংলাভাষীদের কল্যাণে বাংলায় অনুবাদ করা। এ লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
বলতে দ্বিধা নেই যে, এই অভাজনও যে ছিটেফোঁটা কিছু কিছু লিখছি, এর পেছনেরও অন্যতম কারিগর তিনি। যখন নিরাশার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে এই অঙ্গন ছাড়ার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম, তখনই তিনি উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং সার্বিক সহযোগিতার দরাজ হস্ত প্রসারিত করেন। আমার মতো অর্বাচিনের লেখা তাঁর সম্পাদিত বহুল প্রচারিত আল-আবরারে প্রকাশ করে আমাকে উৎসাহিত করেন। বলতে গেলে আমাকে নবজীবন দান করেন। নাহলে লেখালেখির কণ্টকাকীর্ণ রাজপথের বন্ধুর অলিগলিতে এই দিকভ্রান্ত নবীন নাবিক যে কোথায় ছিটকে পড়তো, তার কোন ইয়ত্তা নেই।
একটি অনুযোগ :
আমার একটি বড় অনুযোগ, আল্লামা রফীক আহমদ দা. বা. এর মতো জ্ঞানের মহীরুহ পেয়েও তাঁর প্রতিভা, মনীষা মানুষের সামনে যথাযথভাবে বিকশিত হচ্ছে না। আসলে আমরা বাঙালীরা আমাদের প্রতিভার যথাযোগ্য মূল্যায়ন অতীতেও করিনি, বর্তমানেও করছি না এবং ভবিষ্যতের খবর আল্লাহই ভালো জানেন। 
এজন্য কালের গর্ভে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ, আল্লাম ইসহাক গাজী, ইমাম আহমদ রহ. সহ প্রমুখ জগতকাঁপানো ব্যক্তিবর্গ। এই মিছিলটা কি আরো দীর্ঘ হবে? তাই আল্লামা রফীক আহমদের উত্তরসূরিরা যদি দায়সারা গোছের কিছু করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন, পরবর্তি প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করবে? তাই আমরা তাঁদের প্রতি বিশেষভাবে মাওলানা রিজওয়ান রফীককে আহক্ষান জানাচ্ছিÑ জীবন্ত এই কিংবদন্তির জীবনের ওপর বিশাল গ্রন্থ এবং তাঁর অমর কীর্তি মূল্যায়িত হোক তাঁর জীবদ্দশাতেই।
পাঠকসমাজের কাছে একটি আর্জি রেখে এই লেখার যবনিকা টানছি। তা এই যে, মহান আল্লাহ যেন আমার এই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ও গুরুজনকে আমৃত্যু ইলমের প্রচার-প্রসারে ব্যাপৃত রাখেন। আমীন ॥

লিখেছেন : হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির উখিয়াভী
ওয়েবসাইটে পড়ুন : http://chintasuchinta.wordpress.com/