জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকগণ
এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
🔵 প্রতিষ্ঠা সন : ১৩৫৭ হিজরী।
🔵 প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক :
শায়খুল মাশায়েখ মাওলানা যমীর উদ্দীন (রহ.)
🔵 প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা :
হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব (রহ.)
🔵 প্রতিষ্ঠাতা মুরব্বি :
হযরত মাওলানা ইস্কান্দর সাহেব (রহ.)
🔵 প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক :
কুতুবে আলম হযরত মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.)
🔵 প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক :
হযরতুল আল্লাম মাওলানা আহমদ [ইমাম সাহেব হুজুর (রহ.)]
🔵 দ্বিতীয় পরিচালক :
শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত মাওলানা শায়খ ইউনুস [হাজী সাহেব হুজুর (রহ.)]
🔵 তৃতীয় পরিচালক :
হযরতুল আল্লাম মাওলানা শায়খ হারুন ইসলামাবাদী সাহেব (রহ.)
🔵 চতুর্থ পরিচালক :
হযরতুল আল্লাম মাওলানা নুরুল ইসলাম কদীম সাহেব (রহ.)
🔵 পঞ্চম পরিচালক :
হযরতুল আল্লাম মাওলানা আব্দুল হালিম বোখারী সাহেব (রহ.)
🔵 ষষ্ঠ পরিচালক :
হযরত মাওলানা ওবাইদুল্লাহ হামযা সাহেব (দা.বা.)
🔵 সপ্তম পরিচালক :
হযরতুল আল্লাম মাওলানা আবু তাহের নদভী সাহেব (দা.বা.)
----------------------------------------
কুতুবে আলম হযরত মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর ভাষায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া, পটিয়া প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :
----------------------------------------
প্রতিষ্ঠার পটভূমি :
----------------------------------------
চট্টগ্রাম জেলার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত পটিয়া এক প্রসিদ্ধ থানা শহর। যা সুপ্রশস্ত আয়তন ঘন জনবসতি তদুপরি সরকারি কোর্ট-কাছারি তথা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দরুণ বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তার ওপর আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার বিরাট প্রভাব রয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থলেই দুটি উচ্চ বিদ্যালয় কাছাকাছি অবস্থিত। প্রায় চার মাইল দূরত্বের মধ্য প্রসিদ্ধ এক ডিগ্রি কলেজ। (আর এখন তো সেসব স্কুলের পার্শ্বেই তো পটিয়া কলেজ)। এখানে নামে মাত্র ও কোনো দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না। আলেমদের সংখ্যাও শূন্যের কোঠায়। নামে মাত্র কেউ কেউ থাকলেও তারা প্রচলিত শিক্ষার প্রভাবে প্রভাবিত। সে রূপেই রূপায়িত। তাদের কোনো নেতৃত্বও এখানে চলে না। ইংরেজি পড়ুয়াদের মাঝে এ ব্যাপারে এ কথার অহংবোধ ছিল যে তারা পটিয়াতে আলেম বা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিতদের নেতৃত্ব খতম করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ এখানকার লোকজন সহীহ ইসলাম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অপরিচিত, কুপ্রথা ও বিদ’আতের শিকার এবং নববী সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। বাতিলপন্থী ও ভ্রষ্ট তথাকথিত সুফিরাই ছিল এখানকার নিরীহ ও মূর্খ জনগণের একান্ত অনুসরণীয়-অনুকরণীয় আদর্শ। এমনকি পটিয়া শহরে পূর্ব দিকে এমন তিনটি কবর রয়েছে, যেগুলোতে মৃত ব্যক্তিদের পূর্বমুখী মাথা নিচের দিকে করে জানাযার নামায ছাড়াই উলঙ্গাবস্থায় নাচ-গান ও বাদ্য-বাজনা সহকারে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এককথায়, এখানকার ধর্মীয় অবস্থা অবনতির চরম সীমায় নিপতিত হয়েছিল।
যেসব আকাবিরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাধারণত বাংলার জন্য এবং বিশেষভাবে চট্টগ্রামের জন্য প্রিয় নবী (সা.)-এর সুন্নতকে পুনর্জীবিতকরণ, শিরক-বিদ’আতকে মাটিতে পুঁতে ফেলার এবং দ্বীনি শিক্ষা ও বিশুদ্ধ তাসাউফের (সুফিতত্ত্ব) প্রচার-প্রসারের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন, যারা নিজের নিষ্ঠা, খোদাভক্তি, মেহনত ও আত্মোৎসর্গের দ্বারা এখানে হেদায়াতের আলো ছড়িয়েছেন তুফান গতিতে, তাঁদের একান্ত কামনা-বাসনা ছিল যে পটিয়াতে দ্বীনি শিক্ষার একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হোক। আর আমাদের পূর্বপুরুষগণ এমন ছিলেন যে তাঁদের দ্বারা বহু কঠিন ও জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তাঁদের দ্বারা এমন বহু মহৎ কাজ সম্পাদিত হয়েছে, যেগুলো অলৌকিক ও কারামাত নামে অবহিত করার যোগ্য ছিল। যা সাধারণত বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভবই ছিল, তাঁদের হাতে সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু তাঁদের হাতে পটিয়াতে কোনো শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সেখানকার লোকজন তাঁদের দ্বারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া বোধ হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিল না। তাঁদের গোলামদের তথা শিষ্য-শাগরেদদের ভাগ্যেই তা লেখা ছিল। ফলে সেসব মহাপুরুষের জীবদ্দশায় তাঁদের আশা সফল হয়নি।
যখন তাঁদের বেশির ভাগই দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে যান তখন হযরত মাওলানা যমীর উদ্দীন (রহ.) যাঁকে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের মধ্যে অলিকুল শিরোমণি গণ্য করা হতো শেষ বয়সে মাওলানা ইস্কান্দর সাহেব ও অধম বান্দা আজিজুল হককে পটিয়াতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য মনোযোগী করে তুললেন।
সুতরাং এই মোবারক ইশারার বরকতে (জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠা) কাজ এভাবে শুরু হয়েছে যে—১। মাওলানা ইস্কান্দর সাহেব বাস্তব কার্যাদিতে সরাসরি শরিক না হয়ে সব সময় রুহানি তাওয়াজ্জুহ দিতে থাকেন। ২। অধম (মুফতি) আজিজুল হক জিরি মাদ্রাসায় ছিলাম। সেখানে অধ্যাপনা কাজে স্থির থেকে পটিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও তদবিরে রত ছিলাম। (জামিয়া পটিয়া প্রতিষ্ঠার) এই খিদমতে বাস্তব কর্ম সম্পাদনকারী প্রথম ব্যক্তি হলেন মাওলানা আহমদ সাহেব মোহরবী। যিনি বর্তমানে পটিয়া মাদ্রাসায় ইমাম সাহেব নামে পরিচিত এবং হাদীস শরীফের দরস দানে রত আছেন।
অধম আজিজুল হক বহু উলামায়ে কেরামের কাছে পটিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা করেছি এবং এই খিদমতে আত্মনিয়োগের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু কেউ সাহস জোগায়নি। নিজে জিরি মাদ্রাসায় মুদাররিস ছিলাম। নিজের উস্তাদদের তত্ত্বাবধানে জিরি মাদ্রাসা থেকে পৃথক হওয়ার চেষ্টা করেছি। তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ার কারণে (জামিয়া পটিয়া প্রতিষ্ঠাকাজে অংশ নেওয়ার) এই খিদমতে আত্মনিয়োগ করতে পারিনি। শুভ পরিসরে হঠাৎ মাওলানা আহমদ সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে বললাম, আপনি পটিয়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আমিও কার্যাদি তত্ত্বাবধান করব। (মাওলানা আহমদ) পটিয়ার বাসিন্দা নন, না পটিয়ার বাসিন্দাদের সাথে তিনি সামান্যও পরিচয় বা সম্পর্ক রাখেন, না তাঁর মাঝে ওয়াজ-নসিহতের অভ্যাস আছে, না চাঁদা ইত্যাদির ব্যবস্থা করার বাহ্যিক কোনো যৌক্তিক পন্থা ছিল, তথাপি আমি যখন (মাওলানা আহমদকে) এই আবেদন পেশ করলাম, তিনি দ্বিধাহীনভাবে বললেন, যদি তুমি বলো ইনশাআল্লাহ আমি এই খিদমতের জন্য প্রস্তুত আছি।
পটিয়া থেকে আড়াই মাইল পশ্চিমে এক ভদ্র পরিবারের একজন আলেম মৌলভী ঈসা সাহেবকেও এই খিদমত আরম্ভ করার জন্য আহ্বান জানালাম। তিনিও অত্যন্ত প্রশস্ত অন্তরে এই খিদমতে অংশ নিতে তৈরি হলেন এবং বললেন, আমি এক বছর কাল বিনা বেতনে কাজ করব। অধিকন্তু মাওলানা আহমদ সাহেবের (ইমাম সাহেবের) খাওয়ার ব্যবস্থাও আমার বাড়িতে হবে।
(এতদশ্রবণে) মাওলানা আহমদ সাহেব বললেন, আমার যখন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হলো আমিও বেতনের জন্য নিশ্চিন্ত।
অতঃপর আমরা তিনজন পটিয়া এসে মরহুম মাওলানা হামিদুর রহমান নামক জনৈক বয়স্ক ও সুন্নতের অনুসারী আলেমের সাথে পরামর্শ করার জন্য একত্রিত হলাম। তিনি উক্ত এলাকার আমঞ্জু মুন্সি নামক একজন ধর্মভীরু ও আলেম-ভক্ত লোককেও পরামর্শে শরিক করলেন। মুন্সি সাহেব চেষ্টার পর স্থির করা হলো যে বর্তমানে যেখানে মাদ্রাসা অবস্থিত তার দক্ষিণে পরী দীঘির পাড়, যা একটি পরিচিত এলাকা এবং তুফান আলী মুন্সি সাহেবের প্রভাবশালী পরিবার, সেই এলাকার বাসিন্দা সেখানে ওই পরিবারের সহযোগিতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হবে। আরো সিদ্ধান্ত হলো, আগামী শুক্রবার তুফান আলী মুন্সি সাহেবের মসজিদে উলামায়ে কেরাম ও সালেহীনদের উপস্থিতিতে জুমু’আর নামাযান্তে মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার প্রাথমিক কার্যাদি আঞ্জাম দেওয়া হবে। উক্ত পরিকল্পনানুসারে (পরবর্তী শুক্রবারে) চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের একটি জামাআত যাতে জিরি মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব ও হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ইয়াকুব সাহেবও শরিক ছিলেন—তুফান আলী মুন্সির মসজিদে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তুফান আলী মুন্সির উক্ত ভূমির স্বত্বাধিকারীরা (মাদ্রাসার জন্য জায়গা দেওয়ার) নিজেদের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছপা হয়ে গেলেন এবং বলতে লাগলেন, আমরা পরীর দীঘির পাড়ে কোনো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হতে দিতে পারি না। (কারণ) বিরোধীরা আমাদের সাথে বৈরিতা করবে। তারা পিছপা হওয়া সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই স্থানে জুমু’আর নামাযের পর মাদ্রাসার কাজ আরম্ভ করে দেওয়া হলো। তা এভাবে হলো যে মৌলবী মুসলিম নামের জিরি মাদ্রাসার ফারেগ একজন নোয়াখালী নিবাসী আলেম পটিয়ার পূর্ব দিকে গোবিন্দারখীল এলাকায় কিছু শিশুকে পবিত্র কোরআনের নাজেরা পড়াতেন। মরহুম মনু মিঞা দফাদার ওই মক্তবের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। উপরোক্ত মৌলবী ও মনু মিঞা দফাদার নিজেদের মক্তবের শিশুদের নিয়ে আমাদের অত্র ইজতিমায় শরিক হন। হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব মদ্দাজিল্লুহু মরহুম মাওলানা ইয়াকুব সাহেবকে বললেন, আপনি আল্লাহ তা’আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে এই শিশুদের সূরায়ে ফাতেহা পড়িয়ে দেন। মাওলানা মরহুম মসনুন খুতবা পাঠ করে উপস্থিত শিশুদের সূরায়ে ফাতেহা পড়িয়ে দিলেন। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে মাদ্রাসার নাম রাখা হয় ‘কাসেমুল উলুম’। মোনাজাতের মাধ্যমে মজলিসের সমাপ্তি টানা হয়। কিন্তু সবার অন্তরে মাদ্রাসার জায়গা সম্পর্কে ভীষণ হতাশা ছিল। রাতে মরহুম মাওলানা হামীদুর রহমান সাহেবের বাড়িতে সবাই একত্রিত হলেন। সকলে বিষণ্নতায় নিমজ্জিত ছিলেন। বিনিদ্র রজনী কাটালেন সবাই। শেষ রাত পর্যন্ত মাদ্রাসার জায়গা সম্পর্কে আলোচনা চলল। মৌলবী মুসলিম নোয়াখালবী বলল, মনু মিঞা দফাদারও এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যদি তাঁকে ডেকে তাঁর সাথে (এ ব্যাপারে) আলোচনা করা হয় তবে আশা করা যায় এর একটা সমাধান বের হয়ে আসবে। সুতরাং তাঁকে ডাকা হলো। পুরো পরিস্থিতির বিবরণ তুলে ধরা হলো। তিনিও স্বয়ং বাদ জুমু’আর মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। অবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলেন। মাদ্রাসার জায়গা সম্পর্কে তিনি বললেন, আমি আমার মসজিদে আপনাদের জায়গা দিতে পারি। এখন আপনারা এখানে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। আগামীতে অন্য ব্যবস্থা করা হবে। তবে শর্ত হলো, মাদ্রাসা কোনো সময় আমার এলাকা থেকে স্থানান্তর করবেন না।
এহেন সাহস উৎসারণকারী কথায় উপস্থিত সকলেই যেন হারানো প্রাণ ফিরে পেলেন। বিপদসংকুল রজনী যেন উৎসবমুখর দিনে পরিণত হলো। সকালে এজতেমার সমাপ্তি হলো এবং [মাওলানা আহমদ (ইমাম) সাহেবকে রেখে] সকলে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে প্রত্যাগমন করলেন। পরপর যথাক্রমে মাওলানা আহমদ সাহেব, মৌলবী ঈসা সাহেব, কারী মুসলেম সাহেব ও জিরি নিবাসী মৌলবী আমজাদ সাহেব মাদ্রাসার বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। কিছুদিন (ওই দফাদার বাড়ির) মসজিদেই মাদ্রাসার কাজ চলল। বর্তমানে মাদ্রাসার উত্তর পার্শ্বে যে সকল দোকানঘর রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি দোকানঘর খালি ছিল। মাদ্রাসাকে মসজিদ থেকে ওই দোকানঘরে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কিছুদিন চলার পর মনু মিঞা দফাদার সাহেবের শ্বশুরদের নিকট হতে আড়াই গণ্ডা ভূমি খরিদ করা হয়। যার মূল্য অধম পটিয়ায় উপস্থিত হওয়ার পর আদায় করি। উক্ত স্থানে একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ করা হয় এবং মাদ্রাসা তথায় স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর ২৭ হাত লম্বা একটি মাটির ঘর নির্মাণ করা হয়। এর ব্যায়ভার ঋণ করেই বহন করা হয়, যা অধম পটিয়ায় উপস্থিত হওয়ার পর আদায় করি। এসব কাজ আমার অনুপস্থিতিতেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে আমি জিরি মাদ্রাসায় থেকে এখানে আসা-যাওয়া করতাম। আনুষঙ্গিক ও সামগ্রিক পরামর্শে শরিক থাকতাম। এরই মধ্যে স্থানীয় কিছু হাম আকীদার আলেম আধিপত্য বিস্তার করে মাদ্রাসা দখল করে নেয়। তাদের আধিপত্যের কারণে মাওলানা আহমদকে (মাদ্রাসা থেকে) পৃথক হতে হয়। আমিও কোনো মতে দূরে থেকে সময় ও পরিস্থিতির প্রতীক্ষায় থাকি। যেহেতু তাদের এ আধিপত্য খালেস নিয়্যাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না তাই তাদের ভিত্তি খুব তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তারা মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় জিরি নিবাসী মাওলানা আব্দুল জলীল সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি যখন মাদ্রাসায় উপস্থিত হই তখন এসব উলামায়ে কেরাম মাদ্রাসায় ছিলেন—১। মাওলানা আব্দুল জলীল সাহেব, ২। মৌলবী আমজাদ ও ৩। মৌলবী মুসলিম। মৌলবী ঈসা সাহেবও সে সময় দূরে সরে যান। আরো অন্যান্য হযরতও মাদ্রাসা থেকে পৃথক হওয়ার চিন্তায় ছিলেন এবং অন্য স্থানে চাকরির তালাশ করছিলেন।
(আধিপত্যবাদীদের জুলুমের শিকার হয়ে) মাওলানা আহমদ সাহেব (মাদ্রাসা থেকে) পৃথক হওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন, আপনার অনুমতি পেলে আমি আধিপত্য বিস্তারকারীদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করব। আমি বললাম, কোনোভাবেই তা সমীচীন হবে না। আপনি চলে আসেন। ফলাফল দুই অবস্থার একটি হবে। হয়তো তারা মাদ্রাসা গড়ার ক্ষেত্রে সফল হবে, যা আমাদের জন্য হবে খুশির খবর। অর্থাৎ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আর সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলো। আমাদের কষ্ট করতে হলো না। অথবা তারা ব্যর্থ হবে। তখন এই খিদমত আমরা (পুনরায়) হাতে নেব। তাতে বড় উপকার হবে এটি যে তাদের মধ্যে আর কোনো সময় এরূপ আধিপত্য বিস্তারের বাসনা জাগ্রত হবে না। যারা কাজ করবে তারা সর্ব দিক থেকে নিরাপদ হয়ে যাবে।
----------------------------------------
জিরি থেকে পৃথক হয়ে পটিয়ায় আমার উপস্থিতি এবং এর পটভূমি :
----------------------------------------
কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা যমীর উদ্দীন কুদ্দিসা সিররুহু চট্টগ্রাম শহরে অধম আজিজুল হককে বলেন, তুমি কি জিরি মাদ্রাসা থেকে পৃথক হতে পারবে? আমি তা কবুল করে নিলাম। রমজানের বন্ধের আঠারো দিন পূর্বে এস্তেখারা করে ইস্তেফানামা পেশ করলাম। ইস্তেফানামা পেশ করার পূর্বে জিরি থেকে পৃথক হওয়ার ব্যাপারে অন্তরে খুবই স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা অনুভূত হতো। নিজের সারা জীবনে ভবিষ্যৎ কোনো কাজ সম্পর্কে হয়তো এরূপ স্বস্তি কয়েকবারও অনুভূত হয়নি। পৃথক হওয়ার ব্যাপারে অন্তরে সংশয়ের গন্ধও ছিল না। এর ভবিষ্যৎ খুবই আলোকিত মনে হতো। তথাপি সুন্নতের ওপর আমল করার নিয়্যাতে এস্তেখারা করে নিলাম। এস্তেখারা করার সময় জিরি থেকে নিজেকে পৃথক করা এবং পটিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি অন্তরকে নিবিষ্ট করলাম। এস্তেখারা করে যখন শুয়ে পড়লাম ঘুমের মধ্যে কোনো ব্যক্তি এই আয়াত وعلی اللہ فلیتوکل المؤمنون পড়ে শোনালেন। চোখ খুললে অন্তরে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হলো। ১৩৫৭ হিজরির রমজান শরীফে চট্টগ্রাম শহরে হযরত কুদ্দিসা সিররুহু আর মাওলানা ইস্কান্দর সাহেব ও আমার মধ্যে পটিয়া মাদ্রাসা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সেদিন আলোচনার কোনো ফলাফল হয়নি। অতঃপর ১৭ রমজান পুনরায় একত্রিত হওয়ার জন্য তারিখ নির্ধারিত হয়। পূর্বনির্ধারিত সময়ে আমি শহরে পৌঁছলাম। অতিমাত্রায় বৃষ্টি ঝরছিল। তাঁরা উভয় হযরত উপস্থিত হতে পারেননি। আমি কয়েক দিন শহরে অবস্থান করে সুন্নতি ইতিকাফ আদায়ের নিয়্যাতে ঘরে চলে এলাম। ইতিকাফ শেষে ঈদের নামায আদায়ান্তে রুহানি পিতা ও অদ্বিতীয় মুরব্বি মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব আমাদের ঘরে তাশরীফ নিয়ে এলেন এবং জিরি মাদ্রাসার খেদমতে বহাল থাকার জন্য বাধ্য করলেন। এস্তেফানামা বেকার গেল। বাধ্য হয়ে আরো দুই বছর জিরিতে থাকতে হলো। (শিক্ষাবর্ষ) ১৩৩৭ হি. সেখানে পূর্ণ করলাম। ১৩৫৮ হিজরিতে হযরতে আকদাস (মাওলানা যমীর উদ্দীন) সাহেবের হুজ্জুতাল বেদায় তাঁর সফরসঙ্গী হলাম। হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র কিছুদিন হযরতের ছায়া আমাদের ওপর ছিল। ১৩৫৯ হিজরিতে শুধু আমাদের নয় বরং দুনিয়াকে এতিম করে হযরত (রহ.) আল্লাহর রহমত পানের যাত্রী হলেন। ১৩৫৭ হি. সনের শেষের দিকে পটিয়া মাদ্রাসার যে বুনিয়াদ রাখা হয়েছিল তা সেরূপই থেকে গেল। (বিভিন্নজনের ফিতনার কারণে) উন্নতি তো দূরের কথা, বুনিয়াদও বেবুনিয়াদ হওয়ার উপক্রম হলো। ১৩৫৯ হি. সনে জিরি থেকে পৃথক হয়ে পটিয়ায় উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা আমার অন্তরে পুনর্বার জাগ্রত হলো। ২৩ রাত ধারাবাহিক এস্তেখারা করলাম। এই লম্বা এস্তেখারার বেশির ভাগ সময় মহেশখালী অঞ্চলে অতিবাহিত হয়েছে। ২৩তম রাতে ঘুমের মধ্যে আমাকে কেউ বলছিলেন, সংশয় কেন করছ? যাও—রাস্তা খোলা আছে। কারো নাম নিয়ে বললেন, যা এখন আমার স্মরণ নেই, তুমি কি দেখছ না ওই ব্যক্তি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে এবং রাস্তা খুলে গেছে? এই রাত পোহাতেই সকালে আমি পটিয়ায় উপস্থিত হওয়ার পূর্ণ ইচ্ছা করে ফেললাম। সে সময় পটিয়ায় যেসব আলেম উপস্থিত ছিলেন তাঁদের কাছে (এই খবর নিয়ে) একজন তালেবে ইলম পাঠালাম যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আমি পটিয়ায় উপস্থিতির ইচ্ছা করেছি। আপনাদের মধ্যে যাঁদের ইচ্ছা মাদ্রাসায় থাকতে পারবেন, যাঁরা চলে যেতে চান, যেতে পারবেন। আমি কাউকে থাকতেও বলব না, যেতেও বলব না। কারো দায়িত্ব আমি নেব না। বরং যাঁরা থাকবেন নিজ দায়িত্বে থাকবেন।
আমি পটিয়ায় উপস্থিত হয়ে ‘জমীরিয়া’ শব্দটি নামের সাথে যুক্ত করলাম। এই সম্পর্কযুক্ত করণকে বরকতের কারণ মনে করলাম। বাস্তবে দেখা গেছে, আসলে বরকতের কারণ ছিল। কিছুদিন পর মৌলবী ... কে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দিতে হলো। কিছুদিন পর মৌলবী...কে অব্যাহতি দিতে হলো। তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার সময় মাদ্রাসায় বড় আকারের ফিতনা সৃষ্টি হলো। মাদ্রাসার ভেতর ও বাইরে বদনামি ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর সাথে চারজন শিক্ষকও অব্যাহতি নিলেন। আমি আল্লাহ তা’আলার প্রতিই তাকিয়ে ছিলাম, আল্লাহর রহমতের প্রতীক্ষায় ছিলাম। অব্যাহতি নেওয়া শিক্ষকদের শূন্যস্থান পূরণার্থে আমার চেষ্টা-কুশিশ ছাড়া শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার রহমতে হযরত কুদ্দিসা সিররুহুর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা হাফেজুর রহমান এবং হযরতের আরেক খলিফা মাওলানা উবায়দুর রহমান সাহেব খেদমতে শরিক হলেন। শুরুর দিকে আর্থিকভাবে টানাপড়েন ছিল। শিক্ষকদের বেতন আদায় হতো না। এই হযরতদ্বয়ের সংযুক্তির পর আর্থিক টানাপড়েন শেষ হয়ে যায়। শিক্ষকদের পুরোপুরি বেতন আদায় হতে থাকে। এই অর্থে এটি ছিল মাদ্রাসার উন্নয়নের দ্বিতীয় যুগ।
----------------------------------------
মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক :
----------------------------------------
যেহেতু শায়খুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা যমীর উদ্দীন সাহেব (রহ.)-এর ইঙ্গিতে এই পবিত্র দ্বীনি খেদমতের শুভ সূচনা হয়। তাই তিনিই এই মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক মুরব্বি ও উপদেষ্টা ছিলেন। যখন ১৩৫৮ হিজরি সনের জুমাদাল উলায় হযরত ইহকাল ত্যাগ করলেন সেই বছর শাওয়াল মাসে আমি জিরি থেকে পটিয়া প্রত্যাবর্তনের সংকল্প করলাম। সুতরাং সেই বছরের মাহে রমজানুল মোবারকে হযরত শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর সাথে ইতিকাফ করার ইচ্ছায় সিলেট সফর করলাম। সাথে সাথে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পটিয়া মাদ্রাসাকে ধন্য করার ইচ্ছা হলো এবং এ বিষয়ে একটা দরখাস্ত লিখে হযরতের খেদমতে পেশও করলাম।
হযরত মাদানী সংক্ষিপ্ত আলাপের পর দরখাস্ত মঞ্জুর করলেন। উক্ত পৃষ্ঠপোষকতা শুধু এতটুকুই ছিল যে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসার সেবকবৃন্দ যেন হযরতের মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বরকত অর্জন করতে থাকেন। তবে তিনি সময় ও সুযোগের অভাবে মাদ্রাসার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে, অর্থাৎ উপস্থিত হয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন।
আল্লাহর শোকর এখন পর্যন্ত হযরতের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তার বরকতের কী কারিশমা, তা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করছে।
তিনি সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করতে না পারলেও যে মহান ব্যক্তিবর্গ মাদ্রাসার কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন—
১. হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহ.), ২. হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ (রহ.), সাবেক মুহাদ্দিস হাটহাজারী মাদ্রাসা, ৩. হযরত মাওলানা আহমদ হাসান (রহ.), মুহতামিম, জিরি মাদ্রাসা। এভাবে উল্লিখিত তৃতীয়জন মাদ্রাসার অতি শুভার্থী ও দানশীল এবং বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। আল্লাহ তাঁদের উত্তম জাযা দান করুন।
----------------------------------------
প্রথম শূরা বৈঠক :
----------------------------------------
আমার উপস্থিতির পর সম্ভবত ১৩৬০ হিজরি সনে উলামায়ে কেরাম ও সালেহীনদের এক বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যাতে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব (রহ.) এবং মাওলানা আহমদ হাসান (মাদ্দা.), হাজী আব্দুল লতীফ সাহেব, হাজী নুরুজ্জামান সওদাগর সাহেবসহ আরো বহু উলামা ও সালেহীন উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিতির সংখ্যা প্রায় ৪০-৫০ জন ছিলেন। আমি পটিয়া মাদ্রাসায় উপস্থিত হওয়ার পর মাওলানা আব্দুল জলীল সাহেবকে মুহতামিম বানিয়ে ছিলাম। আমি নিজে শিক্ষক হিসেবে ছিলাম। এই বৈঠকে যখন মুহতামিম পদের কথা এলো তখন মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব ও অন্য উপস্থিত সদস্যগণ এহতেমামের দায়িত্ব আমাকে ন্যস্ত করলেন। মুহতামিমের দায়িত্বের ব্যাপারে আমার সহজাত ভয় ছিল এবং আগে থেকেও এ কাজের সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই বহু ওজর-আপত্তি পেশ করি। কিন্তু তাঁরা সেদিকে কর্ণপাত করেননি। জোরপূর্বক মুহতামিমের দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পিত হয়। নিজ অযোগ্যতার কারণে মানসিক উদ্বেগ অনুভব করি ও ভীতসন্ত্রস্ত হই। কখনো নির্জনে, আবার কখনো জনসমক্ষে অনিচ্ছাকৃতভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তাম। কারণ এত বড় দায়িত্বের জন্য আমি সম্পূর্ণ অযোগ্য। আমি স্বয়ং নিজের মধ্যে এ দায়িত্ব পালন করার মতো যোগ্যতা দেখতে পাচ্ছি না। দায়িত্ব পালনের ত্রুটির ব্যাপারে পরকালে পাকড়াওর জন্য বড়ই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একবার কোনো সফরে হযরত মাওলানা ইস্কান্দর সাহেব (রহ.)-এর সাথে মুহতামিমের বিষয় নিয়ে অনুতাপ মিশ্রিত আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। আমি নিজের ধ্বংসের আশঙ্কা প্রকাশ করলাম। তারপর রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। তখন স্বপ্নে দেখি কে যেন আমাকে বলছিল : ‘তোমার নির্দেশে মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। আর তুমি পরিচালিত হও আল্লাহর নির্দেশে।’ প্রত্যুষে এই স্বপ্ন তাঁর কাছে বর্ণনা করলে তিনি বলেন : আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা আপনার জন্য সান্ত্বনা বার্তা। জনাব মাওলানা ওবায়দুর রহমান (রহ.) ও মাওলানা হাফেজুর রহমানের যখন নিয়োগ হয় তখন শিক্ষকদের ঐকমত্যে মাওলানা ওবায়দুর রহমান সাহেবকে নায়েবে মুহতামিম নিযুক্ত করা হয়। কয়েক বছর তিনি এই দায়িত্ব কঠোর পরিশ্রমের সাথে আঞ্জাম দেন। মাদ্রাসার বহু কাজ তাঁর সুকৌশলের বদৌলতে সুচারুরূপে সাধিত হয়। পাকা দালানের কাজ তাঁর যুগ থেকেই শুরু হয়। মাদ্রাসার কয়েকটি কাঁচা ঘর বন্যায় বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমি স্বপ্নে দেখি, মাওলানা ওবায়দুর রহমান সাহেব (রহ.) কিছু বাঁশ ও কাঠের খুঁটি জোগাড় করলেন। তাঁর হাতে নির্মাণকাজের কিছু সরঞ্জামও ছিল। আমাকে বলছিলেন যে বাঁশ দিয়েই মাদ্রাসা বানাবেন। তেমনিভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে প্রমাণিত হয় যে—একদা এরূপ অবস্থা হলো যে শত চেষ্টার পরেও পাকা কাজের সরঞ্জাম জোগাড় হলো না। কাজ বন্ধ রইল। আমরা সবাই চিন্তিত। মাওলানা ওবায়দুর রহমান সাহেব (রহ.) স্বপ্নে দেখলেন যে হযরত মাওলানা মুহাম্মদ এয়াকুব সাহেব (রহ.), সাবেক প্রধান শিক্ষক, দারুল উলুম দেওবন্দ, এখানে তাশরীফ আনয়ন করেন এবং তাঁকে বলছিলেন যে ‘ওহে! ভয় করবেন না। সরঞ্জাম জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’ তারপর সচ্ছলতা দেখা গেল, কাজ পুনরায় শুরু হলো। মোটকথা, মাওলানা (ওবায়দুর রহমান) সাহেব অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক বছর পর তাঁর অন্যান্য ব্যস্ততা বেড়ে গেলে কাজে ত্রুটি দেখা যায়। কাজেই শিক্ষকদের ঐকমত্যে আলহাজ মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুছ সাহেব (রহ.)-কে (যিনি হযরত হাজী সাহেব হুজুর নামে খ্যাত) নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। হাজী সাহেব (রহ.) আমার শায়খ (রহ.)-এর জামাতা এবং বিশেষ খলিফাও। সাথে সাথে হাফেজে কোরআন ও আলেমে বা-আমল ছিলেন। তিনবার পবিত্র হজব্রত পালন করেন এবং এক বছর মদীনা মুনাওয়ারাতে অবস্থান করেন।
বিশেষ পরামর্শ সভায় কার্যক্রম শেষ করার পর সে সময় যেসব শিক্ষক মাদ্রাসায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে একত্রিত করে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব বললেন, যদি আপনাদের এরূপ ধারণা হয় যে পটিয়াতে কাজের প্রয়োজন তাই আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে সরঞ্জামাদি জোগাড় হয়ে যায় আর বেতন-ভাতা সব ঠিকভাবে চলে, তাহলে কাজে থাকবেন, অন্যথায় কাজ ছেড়ে চলে যাবেন। যদি এই পরিকল্পনা হয়, তাহলে আমরা আজই মাদ্রাসা বন্ধ করে দিচ্ছি। কাজেই সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে যান। মুসলমানদের টাকা-পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। আর যদি এরূপ ধরণা হয় যে আমৃত্যু কাজে লেগে থাকবেন, প্রয়োজনে লোহা ভক্ষণ করবেন, বেতন পাওয়া না পওয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, উপবাসের ওপর থাকবেন সন্তুষ্ট, তাহলে বিসমিল্লাহ করে কাজ শুরু করে দিন। আমরাও জানমাল দিয়ে আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাব। এরপর হুজুর আমাদের সাহস বাড়ানোর উদ্দেশ্যে হাটহাজারী মাদ্রাসার কিছু প্রাথমিক অবস্থা বর্ণনা করলেন। আর বললেন, প্রত্যেক মাসে যে বেতন আপনাদের হস্তগত হবে, তাই আপনাদের বেতন। অনাদায়ী বেতন মাদ্রাসার ওপর ঋণ হয়ে থাকবে না। মুহতামিম সাহেবের দায়িত্ব শুধু চেষ্টা করা! বেতন আদায় করা নয়। এই বৈঠকে মাদ্রাসার জন্য জায়গা ক্রয়ের চিন্তা-ভাবনাও করা হয়েছিল আর উপস্থিত সকলের কাছ থেকে কিছু চাঁদার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয় আর আমার বেতন বিশ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খোরাকি আমার জিম্মায় দেওয়া হলো, মাদ্রাসার জিম্মায় নয়।
----------------------------------------
মাদ্রাসার গ্রন্থাগারের সূচনা :
----------------------------------------
গ্রন্থাগারের জন্য সর্বপ্রথম মাওলানা ইস্কান্দর (রহ.) তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের সব কিতাব দান করেন। তাঁর কিতাব দ্বারাই গ্রন্থাগারের সূচনা হয়। তারপর মাওলানা আহমদুল্লাহ হাওলাভী (রহ.) তাঁর নিজস্ব সব কিতাব দান করেলেন।
এভাবে অন্য আলেমগণ তাঁদের সংগৃহীত পুরাতন কিতাবসমূহ মাদ্রাসায় পাঠাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে কিতাবের একটি বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠল। কুতুবখানার জন্য প্রথম আলমারি দান করেন হাজী আব্দুল লতীফ সাহেব, (যিনি জনাব আলহাজ চাঁদ মিঞা সওদাগরের সন্তান) কিন্তু তখন মাদ্রাসায় কোনো কিতাবের ভাণ্ডার ছিল না। তাই আমি বললাম, মাদ্রাসায় তো কিতাব নেই, আলমারি দিয়ে কী করব? উত্তরে হাজী সাহেব বললেন, আলমারি নিন, কিতাবের ব্যবস্থা আল্লাহই করে দেবেন। এভাবেই গ্রন্থাগারের অগ্রগতি সাধিত হলো।
----------------------------------------
হেফজখানার সূচনা :
----------------------------------------
সাহসিকতার কমতির কারণে আমি অধম প্রথম থেকেই কাজের পরিধি অধিক বিস্তৃত করতে চাচ্ছিলাম না। আমার এমন ধারণা হতো যে যদি কাজের সীমা বিস্তৃত হয়ে যায় হতে পারে আমার মতো স্বল্প বুদ্ধি ও সামান্য ধার্মিকতাসম্পন্ন লোকের জন্য বৃহৎ ও ক্ষুদ্র কাজকর্মে শরীয়তের সীমা রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। আন্তরিক প্রত্যাশা ছিল মাদ্রাসার সব খিদমত পবিত্র শরীয়তের অবকাঠামো মতেই হোক। মাদ্রাসার পরিধি অপ্রশস্ত হলেও তাতে অসুবিধা فکر ہر کس بقدر ہمت اوست ؟ প্রত্যেক চিন্তাধারা তো তার সাহস থেকেই উৎসারিত হয়।
উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে হেফজখানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ারই ইচ্ছা ছিল, যেন কাজের পরিধি বিস্তৃত না হয়। তা ছাড়া অন্যত্র বহু হেফজখানা রয়েছে। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হলো যে মাদ্রাসায় হেফজখানা নেই, আবার এ ব্যাপারে চেষ্টাও নেই। হঠাৎ হাফেজ নূরুল হক (ছিপাতলভী) এসে বললেন, আমার প্রবল ইচ্ছা যে আপনাদের দলভুক্ত হয়ে থাকব। মাদ্রাসার খেদমতের তো আমি যোগ্য নই। কিন্তু ভাবছি, পটিয়ায় কোনো ব্যবসা করব এবং আপনাদের সাথে থাকব। তাঁর এ উক্তি শুনে আমার অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। ভাবলাম হতে পারে হেফজখানার ব্যবস্থা করানোই আল্লাহর ইচ্ছা। আমি তাঁকে বললাম, আপনি তো হাফেজ। সুতরাং হেফজখানার খিদমত তো আঞ্জাম দিতে পারবেন। হয়তো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এটি মঞ্জুর ছিল। তাই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। হাফেজ সাহেব আনন্দচিত্তে এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। হেফজখানা আরম্ভ হয়ে গেল। আল্লাহর রহমতে হেফজ বিভাগ ভালোই চলল। প্রতিবছর ৬-৭ জন ছাত্র হেফজ শেষ করে পাগড়ি অর্জন করতে লাগল। দীর্ঘদিন যাবৎ খিদমত করার পর হাফেজ নূরুল হক (রহ.) হেফজখানার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন। তাঁর পরিবর্তে হাফেজ আব্দুল বায়েছ (রহ.) সাহেব উক্ত খিদমত আঞ্জাম দিতে লাগলেন। সবক এবং দাওরের ছাত্রদের আলাদা করার জন্য হাফেজ ফররুখ সাহেবকে কিছুদিন হেফজখানায় দেওয়া হলো। কিন্তু তা উপকৃত সাব্যস্ত হয়নি। তাই সেটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এখন সবক ও দাওর—সবই একজন হাফেজের তত্ত্বাবধানেই চলছে।
----------------------------------------
দাওরায়ে হাদীসের উদ্বোধন :
----------------------------------------
স্বীয় অযোগ্যতা ও সার্বিক দুর্বলতার ফলে এই সুমহান কর্মসম্পাদনের সাহস হচ্ছিল না। কয়েক বছর যাবৎ ছাত্ররা হেদায়া, জালালাইন, মিশকাত ইত্যাদি কিতাবের পাঠ শেষে বিদায় নিয়ে চলে যেতে লাগল। কোনো কোনো বন্ধু-বান্ধব দাওরায়ে হাদীস চালু করার অনুরোধ করে বললেন, প্রত্যেক বছর যথেষ্ট সংখ্যক ছাত্র মিশকাত ও জালালাইন পাঠ শেষ করছে। তাদের নিয়ে দাওরায়ে হাদীস চালু করলে অসমীচীন হবে না। কিন্তু আমি সিহাহ সিত্তাহ তথা হাদীস শাস্ত্রের ছয়টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ ও সহায়ক ব্যাখ্যা গ্রন্থাদির অভাব এবং নিজের অযোগ্যতা দেখিয়ে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে চলেছি। সর্বপ্রথম সম্ভবত শোভনদণ্ডী এলাকার একজন দ্বীনদার ব্যক্তি মরহুম হাজী আমজু সাহেব এক কপি বোখারী শরীফ দান করলেন। আমি তাঁকে বললাম, আমাদের মাদ্রাসায় বোখারী শরীফ পড়ানো হয় না। তাই যে মাদ্রাসায় বোখারী পড়ানো হয় সেখানেই তো আপনার দান করা উচিত। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হলেন না। তিনি বলতে লাগলেন, আমার খুব ইচ্ছা যে আপনাদের মাদ্রাসায়ই এই কিতাব দান করব। এরপর সিহাহ সিত্তাহর আরো কপি আসতে লাগল। যখন বেশ কিছু কপি জমা হয়ে গেল, তখন শিক্ষকবৃন্দকে বললাম, এই কিতাবগুলো কাজে লাগানোর একটা উপায় হচ্ছে আমরা সবাই আসরের নামায শেষে একত্রিত হয়ে বসে যাব। আমাদের মধ্যে যেকোনো একজন হাদীস পড়ে তার অনুবাদ ও বিশ্লেষণ করবেন, অন্যরা তা শুনবেন। এতে করে কিতাব দানকারীরাও সাওয়াব পাবে, সাথে সাথে আমরাও উপকৃত হবো এবং মাদ্রাসায়ও বরকত আসবে।
এর ধারাবাহিকতা কিছুদিন যাবৎ চালু ছিল। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। আমি এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম, ওজু করতে বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে, যার কারণে নামাযে শরিক হতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমার মনে হলো যে নাহু ছরফসহ বৈয়াকরণিক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলির পাঠদানে সময় বেশি ব্যয় হচ্ছে এবং হাদীস শরীফের খিদমত শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই আল্লাহর তরফ থেকে সতর্কতা এসেছে। হযরত আল্লামা ইব্রাহীম বলিয়াভী (রহ.) সেই সময় হাটহাজারী মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে অবস্থান করছিলেন। আমি তাঁর নিকট স্বপ্নের বর্ণনা করলে উত্তরে তিনি বললেন, দাওরায়ে হাদীসের ক্লাস আরম্ভ করে দেওয়া চাই। আমি এ ব্যাপারে নিজের অযোগ্যতাপ্রসূত দুর্বলতা ও হীন সাহসিকতার অনুযোগ করলাম। তিনি বললেন, হীন সাহসিকতার কোনো কারণ নেই। আমি নিজে উপস্থিত হয়ে দাওরায়ে হাদীসের সবক শুরু করে দেব। অবশেষে তা-ই হলো। দাওরায়ে হাদীস অধ্যয়নপ্রত্যাশী ১০-১২ জন ছাত্র নিয়ে দাওরায়ে হাদীসের ক্লাস আরম্ভ হলো। মাওলানা আহমদ মোহরবী (ইমাম সাহেব) ও মাওলানা আমীর হুসাইন রোদরভী (মীর সাহেব) এই খিদমতের জন্য মনোনীত হলেন। আল্লাহর ফজলে এই মহান ব্যক্তিদের মাধ্যমে এই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কাজ অদ্যাবধি পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগল।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখলেন যে মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব [মাওলানা আমীর হুসাইন সাহেব (রহ.)-এর বড় ভাই ও চট্টগ্রামস্থ মোজাহের উলুমের প্রতিষ্ঠাতা] পটিয়া মাদ্রাসায় এলেন এবং বললেন, এখানে নবী করীম (সা.) হাদীস পড়িয়েছেন। সুতরাং আমরাও এখানে হাদীস পড়ব। দাওরায়ে হাদীসের ক্লাস শুরু করে দেওয়ার পর অতি সহজে সিহাহ সিত্তার কিতাব ও প্রচুরসংখ্যক হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ জমা হয়ে গেল। বর্ষশেষে শায়খুল হাদীস মাওলানা সাঈদ আহমদ সাহেব (রহ.)-এর পবিত্র হাতে ছাত্রদের পাগড়ি পরিধান করা হতো। তাঁর মৃত্যুর পর আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ, জিরি মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেবের পবিত্র হাতে দস্তারবন্দির কাজ সম্পন্ন হতে থাকে।